বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক সমাজে কোরআন হেফজের একটি গৌরবজনক
অবস্থান রয়েছে। কোরআনের হাফেজ হওয়া যে কোনো মুসলমান পরিবারে গর্বের বিষয়, বিশেষত যদি সেটা হয় অল্প বয়সে। কিন্তু এবার দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছেন মাত্র ৭ বছর বয়সী এক বিস্ময় শিশু, মুহাম্মদ। যিনি মাত্র ৯ মাসে পুরো পবিত্র কোরআন হিফজ করেছেন, তাও তার মায়ের কাছ থেকে শিখেই।
📍 মুহাম্মদের গ্রামের ঠিকানা ও পারিবারিক পরিচয়
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার সাতবাড়ীয়া গ্রামের সন্তান মুহাম্মদ। তার বাবা মুফতি আবদুল্লাহ আমজাদ একজন সম্মানিত আলেম এবং ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত। মুহাম্মদের মা, আলেমা মাছুমা জান্নাত, নিজেও একজন ইসলামি শিক্ষিকা এবং ‘মাছুমা জান্নাত মহিলা মাদরাসা’ পরিচালনা করেন। ছোট্ট মুহাম্মদ এই মাদরাসাতেই হিফজ শুরু করে এবং মাত্র ৯ মাসে তা সম্পন্ন করে সবাইকে চমকে দেয়।
🧕 মা ও নানির অনন্য ভূমিকা
হিফজ শিক্ষা শুধু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক না হয়ে পারিবারিক পরিমণ্ডলেও সম্ভব—তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই পরিবারটি। মুহাম্মদের মা মাছুমা জান্নাত নিজেও একজন হাফেজা। তিনি নিজে তার মায়ের, অর্থাৎ মুহাম্মদের নানির কাছ থেকে হিফজ সম্পন্ন করেন। ফলে হিফজের এই শিক্ষা পরিবারিক ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মুহাম্মদও তার মা ও নানির কাছেই হিফজ সম্পন্ন করে।
এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, কারণ সাধারণত শিশুরা কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে কয়েক বছর সময় নিয়ে হিফজ সম্পন্ন করে। সেখানে মাত্র ৭ বছর বয়সে, এবং মাত্র ৯ মাসে সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করে মুহাম্মদ বুঝিয়ে দিয়েছে—প্রত্যয়, পরিশ্রম ও উপযুক্ত পারিবারিক পরিবেশ থাকলে অসম্ভব কিছুই নয়।
📚 ৯ মাসের ধৈর্য, অধ্যবসায় আর আত্মত্যাগ
একটি শিশু কিভাবে এত কম সময়ে পুরো কোরআন হিফজ করতে পারে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে। হিফজ একটি কষ্টসাধ্য কাজ, যা নিয়মিত অনুশীলন, সময়নিষ্ঠতা, মনোযোগ এবং বিশাল মানসিক শক্তি দাবি করে। আর একটি সাত বছরের শিশুর পক্ষে এসব বিষয় ধরে রাখা খুবই দুরূহ।
কিন্তু মুহাম্মদ সেটা করে দেখিয়েছে। তার প্রতিদিনের রুটিনে ছিল কোরআন শিক্ষা, মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী আয়াত অনুশীলন, পুরোনো আয়াত পুনরাবৃত্তি ও নতুন আয়াত মুখস্থ করা। মা মাছুমা জান্নাত সার্বক্ষণিক নজর রেখেছেন যেন কোনোদিনের অধ্যয়ন বাদ না যায়। সন্তানকে নিজের হাতে হাফেজ বানানোর জন্য মা মাছুমা জান্নাতের এই শ্রম, আন্তরিকতা ও আত্মোৎসর্গ প্রশংসার দাবিদার।
🗣️ বাবার আবেগঘন অনুভূতি
বিস্ময় বালক মুহাম্মদের বাবা মুফতি আবদুল্লাহ আমজাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, মুহাম্মদ যেটা করেছে, এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যায় না। আমাদের পুরো পরিবারই পবিত্র কোরআনের সাথে জড়িত। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, স্ত্রী—সবাই হাফেজ। আমি চাই, আমার সন্তান শুধু হাফেজ নয়, একজন আদর্শ আলেম ও দাঈ হোক, দেশ-জাতির গর্ব হোক।”
তার কণ্ঠে ছিল গর্ব, কৃতজ্ঞতা ও মহান রবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ। একটি পরিবার যখন ধর্মীয় শিক্ষাকে জীবনযাপনের মূলভিত্তি হিসেবে ধরে, তখন এমন অলৌকিক ঘটনা বাস্তবে রূপ নিতে পারে—এটা তারই উদাহরণ।
🎉 সম্মাননা ও উদযাপন
মুহাম্মদের হিফজ সম্পন্ন হওয়াকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার (১০ জুন) মাছুমা জান্নাত মহিলা মাদরাসায় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে স্থানীয় আলেম-ওলামা, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং গ্রামবাসীরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে মুহাম্মদের মাথায় ‘সম্মাননা পাগড়ি’ পরিয়ে দেন বরেণ্য আলেমরা। এ সময় মঞ্চে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কোরআনের আয়াত পাঠ, দোয়া মাহফিল, এবং হাফেজ মুহাম্মদের জন্য বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।
এই বিশেষ আয়োজন ছিল কেবল একটি শিশুর অর্জনের স্বীকৃতি নয়, বরং পুরো একটি ইসলামী আদর্শভিত্তিক পরিবার ও শিক্ষার প্রতিচ্ছবি।
🌍 সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন
মুহাম্মদের এই অর্জন শুধু একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আজ দেশের মুসলিম সমাজে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কিভাবে একটি শিশু, যার বয়স খেলাধুলার সময়, সে কিনা নিজ মায়ের কাছে বসেই পবিত্র কোরআনের হাফেজ হয়ে উঠল, তা অনেক পরিবারকে নতুন অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
বর্তমানে প্রযুক্তি ও মোবাইল আসক্তির যুগে যখন অনেক শিশু কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, তখন মুহাম্মদের মতো শিশুদের সফলতা এক নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
💡 ভবিষ্যৎ স্বপ্ন
শিশু মুহাম্মদ এখনও অনেক ছোট। কিন্তু তার পিতামাতার স্বপ্ন অনেক বড়। তারা চান, মুহাম্মদ বড় হয়ে ইসলামী শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করুক, দাওয়াতি ময়দানে কাজ করুক, ইসলামের আলো পৃথিবীর সকল প্রান্তে ছড়িয়ে দিক।
এই মুহাম্মদই হয়তো একদিন আন্তর্জাতিক হিফজ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে, হয়তো সে হবে বিশ্বসেরা হাফেজদের একজন। এমন স্বপ্নই এখন শুধু তার পরিবারের নয়, গ্রামের প্রতিটি মানুষের চোখেও।
✅ উপসংহার
মুহাম্মদের এই অভাবনীয় সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পারিবারিক বন্ধন, ধর্মীয় অনুশাসন, ও একাগ্রতার সম্মিলিত প্রয়াসে যে কোনো অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। মা মাছুমা জান্নাত শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি একজন আদর্শ মা যিনি সন্তানকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করেছেন।
৭ বছরের শিশুর এমন অর্জন আমাদের সবাইকে আবারও ইসলামী শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করে। যদি একটি পরিবার চায়, তবে আজও ঘরে ঘরে মুহাম্মদের মতো হাফেজ তৈরি করা সম্ভব।